ঢাকার গুলশান-২ এলাকার একটি আইসক্রিমের দোকানের সামনে ছোট একটি চায়ের দোকান। তরুণ-তরুণীদের ভিড় লেগেই থাকে সেখানে। কারণ, চা-সিগারেটের সঙ্গে এখানে সহজেই মেলে ইয়াবা, নেশাখোরদের কাছে যার পরিচিতি 'বাবা' বলে। রাজধানীর নেশার রাজ্য এখন পুরোপুরি এই 'বাবা'র দখলে।
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, তারকাখচিত ও অভিজাত হোটেলের লবি-বারসহ অনেক জায়গায় চলছে ইয়াবা বিক্রি ও সেবন। একসময় ইয়াবা অভিজাত নেশাখোরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্তদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। তাই প্রতিনিয়ত ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে এর বিক্রি। ইয়াবা আমদানি ও বিক্রির কাজে রাজধানীতে কমপক্ষে ১৫টি সিন্ডিকেট সক্রিয় আছে। এতে রোহিঙ্গাও আছে বলে প্রমাণ মিলেছে। ডিলারদের নির্ধারিত এজেন্টরা গাড়িতে করে নির্ধারিত স্থান বা ক্রেতার কাছে পেঁৗছে দেয় ইয়াবা। মাঝেমধ্যে দু-একজন ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে ফের সক্রিয় হয় পুরনো ব্যবসায়। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে 'ইয়াবা সার্কেল'। এসব সার্কেলের বাইরে এ মাদক বেচাকেনা বা সেবন খুব একটা চলে না।
বিশিষ্ট মনোচিকিৎসক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ইয়াবা নামের এই মাদকটি দেহের মারাত্মক ক্ষতি করে। এ মাদক সেবন করলে দেহের রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। অনিদ্রা হতে পারে এবং এ থেকে নানান দৈহিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ইয়াবা সেবনে ফুসফুসের ক্ষতি ও ক্ষুধামন্দা হতে পারে। ব্রেইন স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর ইনজেকশন ফর্মে বেশি ডোজ নিলে আকস্মিক খিঁচুনি হয়ে মৃত্যুও হতে পারে।
মোহিত কামাল আরো জানান, এই মাদক একবার নিলে বারবার নিতে হয়, ছাড়া যায় না। এতে কর্ম ও যৌনক্ষমতা কমে যায়।
রমরমা 'ডিজে বার' : রাজধানীর অভিজাত তারকা হোটেল ছাড়াও ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরায় গড়ে উঠেছে কিছু নাইট ক্লাব ও ডিজে বার। এসব বার ও ডিজে পার্টি ইয়াবা বিক্রি ও সেবনের বড় পয়েন্ট। অনেক সময় আয়োজকরাই, পাশাপাশি একশ্রেণীর 'ড্যান্স গার্লরাও' বারে আগতদের মধ্যে ইয়াবা সরবরাহ করে থাকে। ডিলারদের লোকজনই ওই সব ক্লাব বা বারে সময়মতো ইয়াবা পেঁৗছে দেয়। অভিযোগ আছে, রাজধানীর কিছু তারকা হোটেলের বারগুলোতেও চলে এ রকম। তবে সোনারগাঁও, শেরাটন ও রিজেন্সি হোটেলের কর্মকর্তারা তা অস্বীকার করেছেন। শেরাটন হোটেলের সিনিয়র সিকিউরিটি অফিসার শাহনূর ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি পৌনে পাঁচ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। এখন পর্যন্ত এখানে ইয়াবা বিক্রির কোনো তথ্য পাইনি। পুরো হোটেলটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার আওতাধীন। এখানে ইয়াবা বিক্রি বা সেবনের সুযোগ নেই।' ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফা আফরোজ বলেন, 'টপ ফ্লোর পর্যন্ত কড়া নিরাপত্তা দেওয়া হয়। সবাই সতর্ক থাকি। এখানে ইয়াবা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।' সোনারগাঁও হোটেলের সুপারভাইজার জামান বলেন, 'আমাদের চোখে এ ধরনের কিছু পড়েনি। আমরা সব সময় সতর্ক থাকি, যাতে হোটেলের কোনো বদনাম না হয়।'
সেবনে এগিয়ে যারা : উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ইয়াবা সেবন করে_এত দিন এটাই প্রচলিত ছিল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ইয়াবার নেশায় বন্দি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থীও ইয়াবা সেবনের পাশাপাশি বিক্রির সঙ্গেও জড়িত। সরেজমিন একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে ইয়াবা বিক্রির সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানের বিবিএর এক ছাত্রী কালের কণ্ঠকে জানান, সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে ইয়াবা বিক্রি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়েরই কজন ছাত্রছাত্রী ইয়াবা বিক্রি করে। ক্রেতাদের বড় অংশ ছাত্র। অন্য ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরাও এখান থেকে ইয়াবা কিনে নিয়ে যায়। তাঁর দাবি, ইয়াবা ব্যবসায়ী নিকিতা ধরা পড়ার পরে কিছুটা কমে। এখন আগের চেয়ে বেশি। বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা নাজনীন সুলতানা বলেন, অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার পথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাদক সেবন করতে দেখা যায়। বিকেলের পর থেকে তারা অনেকটা প্রকাশ্যে এ কাজ করে।
শখের মাদক এখন মরণব্যাধি : বাংলাদেশে ইয়াবার আগমন ঘটেছিল নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। ধনাঢ্য কিছু মানুষের নিতান্তই শখের বিষয় ছিল ইয়াবা। 'লাগেজ পার্টি'র লোকজন দুই-তিন পাতা করে বিদেশ থেকে আনত। পরে ১৯৯৭ সালে আকাশপথে ইয়াবা আনেন তৎকালীন একজন বিতর্কিত এমপি। ওই এমপি তাঁর এক বিমানবালা বান্ধবীর মাধ্যমে ইয়াবা আনেন। তা অল্প অল্প করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত হতে থাকে। পরে ২০০০ সালে গুলশান থেকে প্রথম ইয়াবাসহ ধরা পড়ে জুয়েল নামের একজন। সে-ই অভিজাত ঘরের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রথম ইয়াবার পরিচিতি ঘটায়। পরে তার নামই হয়ে যায় 'ইয়াবা জুয়েল'।
ইয়াবার হোতারা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই জুয়েল এখনো রাজধানীর বড় মাপের একজন ইয়াবা ডিলার। এ ছাড়া অন্যতম ডিলার হচ্ছে কঙ্বাজার-টেকনাফের ফোরকান। সে বড় বড় চালান ঢাকায় আনে। উত্তরা এলাকায় নরুল সাঈদ, পুরান ঢাকায় পরাগসহ অনেকেই ডিলারি করে। ডিলারদের থাকে সরবরাহকারী। তারাই সেবনকারী বা ক্রেতাদের কাছে চাহিদামতো পেঁৗছে দেয়। গত মাসে সায়েদাবাদ থেকে মিজান নামের এক 'হুজুররূপী' সরবরাহকারীকে ইয়াবাসহ আটক করা হয়। তার বাড়ি টেকনাফে। বর্তমানে সে কারাগারে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের বড় একটি গ্রুপও আছে এ কাজে। দিন দশেক আগে ৬০০ ইয়াবাসহ আমির নামের এক রোহিঙ্গা কিশোরকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, তার মা-বাবা টেকনাফে থাকে। তারা নিজেরাই এসে ইয়াবা পেঁৗছে দেয়। পরে সে সরবরাহ করে। কঙ্বাজার-টেকনাফে তাদের মতো এমন বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা এ ব্যবসায় জড়িত।
ইয়াবা রুট : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানান, একসময় কঙ্বাজারের টেকনাফ সীমান্ত এলাকাটি ইয়াবা ঢোকার একমাত্র রুট হলেও বর্তমানে খাগড়াছড়ির গহিন এলাকা দিয়ে ইয়াবা আসছে। এর বড় একটি অংশ রাজধানীতেও প্রবেশ করে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার উপপরিচালক মেজর শাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতি বছর ইয়াবা বিক্রির অভিযোগে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫৭১ জনকে গ্রেপ্তার এবং ৭৩ হাজার ২২৪ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এর আগে আমিন হুদা, নিকিতা, জয়নালের মতো বড় বড় ইয়াবা বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হলেও তারা পরে জামিনে বের হয়ে আসে। এর পরও র্যাবের চেষ্টা থেমে নেই।
http://www.sonarbangladesh.com/newsdetails.php?ID=9696Source